মেয়েটি বিশ্বকাপ দেখল

বিশ্বকাপ ক্রিকেট / নববর্ষ (এপ্রিল ২০১১)

মুশফিকুর রহমান সুমিত
  • ২৮
  • 0
  • ৪৩
নিপু একজন চতুর্দশী। মফস্বলের মেয়ে সে। স্কুল শেষ করল, মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করল। এখন শুধু ছুটি। খুব খোশ মেজাজেই আছে সে! মন ভালো থাকার সবচেয়ে বড় কারন কিন্তু ছুটি নয়; কারণটি হল বিশ্বকাপ ক্রিকেট! এবারের বিশ্বকাপের সহ আয়োজক বাংলাদেশ। দাদার সাথে অনেকদিন আগেই কথা পাকা করা ছিল, পরীক্ষা শেষে নিপুকে নিয়ে তিনি ঢাকা যাবেন। শুধু যাবেনই না, স্টেডিয়ামে বসে নিপুকে নিয়ে খেলাও দেখবেন। বলা বাহুল্য যে দাদা নিজেও ক্রিকেট এর চরম ভক্ত। তাই নিপু খুব ভালমতই জানে যে দাদা এই ওয়াদার বরখেলাপ করবেন না। তাইতো তার এত উত্তেজনা!

দেখতে দেখতে শুরু হয়ে গেলো স্বপ্নের বিশ্বকাপ। বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্ববাসী সোনার বাংলাকে নতুন করে চিনল। কিন্তু আগের উত্তেজনাটা নিপুর মধ্যে আর কাজ করছে না। করবেইবা কেন? টাইগাররা গ্রুপ পর্যায়ের ৫ টি ম্যাচ খেলে ফেলেছে এবং জিতেছে ৩ টিতে! একটাও নিপু গ্যালারিতে বসে দেখতে পেল না। কেন? কারন একটাই। ৫ টি খেলার কোনটিরই টিকেট দাদার ভাগ্যে জোটেনি। টানা ২দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও দাদা তার আদরের ছোট্ট বোনটির জন্য টিকেট এর বেবস্থা করতে পারেননি- আর নিজের জন্যতো না-ই।

আজও দাদা ঢাকা গেছেন। টিকেট যে কত দুষ্প্রাপ্য বস্তু তা নিপুর বোঝা হয়ে গেছে। স্বয়ং বিধাতা ২টা টিকেট আলাদা করে না রেখে দিলে যে আজও দাদা খালি হাতে আসবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। টিকেট নিপুর ২ টা-ই চাই। কারন এই একমাত্র দাদা তার জানের জান। যে দাদা এত কষ্ট করে রাত-দিন ভুলে গিয়ে তার জন্য টিকেট নিয়ে আসতে গেছেন তাকে রেখে নিপু কখনই একা খেলা দেখতে যাবে না। “গেলে ২ জন এক সাথে, আর না গেলে কেউ না”- নিপুর সাফ কথা। দেখা যাক আজ ভাগ্যে কি আছে।


বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হল। দাদা আসেননি। তবে দুশ্চিন্তার কারন নেই। দাদার সাথে কথা হয়েছে। টিকেট নিয়েই দাদা বাড়ি ফিরছেন! নিপুর খুশি আর দেখে কে? খুশিতে তার নাচতে ইচ্ছে হচ্ছে! রাত এখন প্রায় ১১টা। নিপুর চোখে ঘুম নেই। দাদা এলে দাদাকে খাইয়ে টিকেট নামক সোনার হরিণ হাতেয় নিয়ে তবেই তার ঘুম।

অবশেষে দাদা এলেন। দরজায় দাঁড়িয়েই নিপুর হাতে দিলেন টিকেট দুটো! টিকেট দুটো হাতে পেয়ে নিপুর মুখে যে হাসি দাদা দেখলেন তাতেই সব ক্লান্তি জলের মত ভেসে গেলো কোন অজানা সাগরের দিকে। এই হাসি দেখে দাদার মনে পরল ছোট্ট নিপুর কথা। নিপু যখন ছোট ছিল তখন প্রায়ই দাদা ওর জন্য মিমি, চকলেট আর এটাওটা নিয়ে আসতেন। চোখের মণি বোনের হাতে সেগুলো দিয়েই কোলে তুলে নিতেন তাকে। আর পৃথিবীর সব সুখ যেন সেই মুহূর্তটির জন্য ২ ভাইবোনের হয়ে যেত! আজ বোনটি বড় হয়ে গেছে। তাই কোলে নিতে ইচ্ছা করলেও তা নেয়া সম্ভব হয় না। তবে নিপু দাদাকে কথা দিয়েছে। যদি দাদা তার কথা রাখতে পারেন এবং যদি বাংলাদেশ জিতে যায় তাহলে বাড়ি ফিরেই নিপু লাফিয়ে উঠে পরবে দাদার কোলে- ঠিক ছোট বেলার মতন!

অবশেষে এলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ! নিপু আর দাদা আজ রাতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়বে। সকালে গিয়ে উঠবে এক আত্মীয়ের বাসায়। তারপর দুপুরেতো খেলা-ই! নিপুর যেন আর তর সয় না! বিদায় কালে বাবা নিপুকে বললেন, “যা, মনের সাধ মিটিয়ে খেলা দেখে আয়। তবে শর্ত একটাই। গ্যালারিতে বসে যদি টাইগারদের না জেতাতে পারিস তবে বাড়ি ঢুকতে দিব না...” হাসি মুখেই নিপু বাবার দেয়া শর্ত লুফে নিল। নিবেইবা না কেন? টাইগারদের উপর যে নিপুর অগাধ আস্থা!

ভালমতই তারা ঢাকায় পৌঁছাল। একটু বিশ্রামের পর রওনা দিল স্টেডিয়ামের উদ্দেশ্যে! ঢাকায় এটাই নিপুর প্রথম আগমন নয়। এর আগেও সে ঢাকায় এসেছে। কিন্তু এবারের ঢাকা যেন অন্য রকম! সব জায়গায়ই কেমন একটা সাজ সাজ রব! নিপুর বুঝতে অসুবিধা হল না যে এই সব সাজই বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে। স্টেডিয়াম এলাকায় ঢুকেতো নিপু আর কিছু ভাবতেই পারল না। শুধু দেখে গেলো ২চোখ মেলে! দাদার পেছন পেছন অনেকটুকু হেঁটে তারা স্টেডিয়ামে ঢুকল। অল্প খুঁজেই পেয়ে গেলো তাদের সিট।

টসে জিতল বাংলাদেশ। সিদ্ধান্ত হল ব্যাটিং করার। নিজের চোখকে যেন নিপুর বিশ্বাস হচ্ছিলো না যখন সে টাইগার ওপেনার ২জনকে তার চোখের সামনে দিয়ে মাঠে প্রবেশ করতে দেখল! সে এক অন্য অনুভূতি যা নিপু ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না কখনই! বিস্ময়ের ঘোর কাটল দর্শকদের হ্রস্বধ্বনিতে যখন ইনিংসের প্রথম বলেই একটা দর্শনীয় চার মারলেন নিপুর অত্যন্ত প্রিয় টাইগার ওপেনার! এরপর পুরো ইনিংস জুড়ে একবারও নিপু শান্ত হয়ে বসলো না। আর বসতে দিলে তো? টাইগার ব্যাটসম্যানরা যে একের পর এক ৪ আর ৬ দিয়ে গ্যালারিকে মাতিয়ে রাখল!

৫০ ওভার ব্যাটিং করে টাইগাররা করল ২২৩/৯। মিরপুরের পিচে বেশ ভালো একটা পুঁজি! নিপুর মনটা খুশিতে ভরে গেলো। দাদাকে ডেকে বলল, “দাদা, জয়ের ঘ্রান পাচ্ছি!” সত্যিই জয় এলো! প্রতিপক্ষকে মাত্র ১৭৫ রানে থামাল বাংলার দামাল ছেলেরা। বাংলাদেশ উঠল শেষ ৮ এ! আহ! কি আনন্দ পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে! নিপু এত আনন্দ কখনো দেখেনি। এক সাথে এত মানুষের হৃদয় তটিনীর সুখের কল্লল নিপুর ছিল পুরোই অজানা! আজ জানা হল। মনের ভিতর যে অনুভূতি কাজ করছে তা একেবারেই ভিন্ন। নিপুর মনে হচ্ছিলো জীবনে আর বুঝি কিছু প্রয়োজন নেই- সে বুঝি সব পেয়ে গেছে। দাদার ডাকে সে ফিরে এলো বাস্তবে। এবার যাওয়ার সময়।

স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে অনেক দূর পর্যন্ত হাঁটতে হল। হাঁটতে হাঁটতে ২ ভাইবোনে অনেক কথা হল। দাদা বলল, “মানুষের একটা প্রবৃত্তি হল সুখ বণ্টন করা। আর একই সুখ যদি অনেক মানুষের মন ছুঁয়ে যায় তবে সেটাই হল পবিত্রতম সুখ।” নিপু মনে মনে ভাবল, আজ সবাই খুশি; সবার চোখে মুখে তা যেন ঠিকরে পরছে। তাইতো তার আনন্দও বেড়ে গেছে অনেক গুণ! হঠাৎ করেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। কেন জানি মনে হল এটাই তার জীবনের শেষ আনন্দ! ভাবতে ভাবতে ওরা পৌঁছে গেলো একটা গ্যাস স্টেশনের কাছে। সেখানে বেশ কয়েকটি অটোরিক্সা গ্যাস নিচ্ছিল। দাদা একটি অটোরিক্সা ঠিক করলেন। আজ রাতে ওরা ঢাকায় ওই আত্মীয়ের বাসায় থাকবে। তারপর কাল ভোরে রওনা হবে বাড়ির উদ্দেশ্যে; একটি সফল ঢাকা ভ্রমনের পর।

সারাদিনে খুব বেশি কিছু খায়নি ওরা কেউই। তাই নিপুকে স্টেশনের সামনে রেখে দাদা গেলেন পাশের দোকান থেকে কিছু কিনতে। নিপু বড় হলে কি হবে, আজও চকলেট তার খুব ভালো লাগে। দাদা ওর জন্য রকমারি চকলেট আর চিপস কিনে কাউনটারে টাকা দিতে গেছেন, তখনই শুনলেন একটা বিকট শব্দ। বাইরে এসে যা দেখলেন তা বিশ্বাস করতেও বেশ সময় লাগলো তার। শব্দটি ছিল গ্যাস স্টেশনের একটি গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণের শব্দ। বেশি কাছে যেতে পারল না দাদা। অনেক ধোঁয়া! ধোঁয়ার আঁধার কিছুটা কাটার পর চোখের সামনে যা দেখতে পেল তা ছিল আর এক বিস্ফোরণ! এই বিস্ফোরণ তার দৃষ্টির, তার অনুভুতির। চোখের সামনে আদরের ছোট বোনের অচেতন দেহ দেখে দাদা হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পরলেন। চেতনা হারিয়ে সেখানেই পরে গেলেন।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন দাদা হাসপাতালে। কোথায় আছেন তা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় নিলেন। যখন বুঝতে পারলেন তখন আর অপেক্ষা করলেন না। ছুটে গেলেন ওয়ার্ডের বাইরে। খোঁজ করলেন ছোট বোনের। বোনকে পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি দাদার। তবে পেয়ে ভাবলেন, “না পেলেই হয়তো ভালো হত।” একজন ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী আর একজন নার্স দাদাকে নিয়ে গেলেন লাশ রাখার ঘরটিতে; বোনের কাছে। বোনটি তার শুয়ে আছে একটা ট্রে এর ভেতর। পরিবেশটা কেমন জানি হিমশীতল। দাদার মনে হল, “কতক্ষণ নিপু এখানে শুয়ে আছে? ওরতো ঠাণ্ডায় অ্যালার্জি। বেশিক্ষন থাকলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।” কোলে নিতে না পারার দুঃখে যে দাদা নিজের মনকে বুঝ দিত “বোন বড় হয়ে গেছে” বলে, আজ কি বলে সে মনকে বুঝ দিবে? মনটা যে আজ বড়ই অবুঝ। চকলেটগুলো এখনো পকেটে রয়ে গেছে। সেগুলো কে খাবে?

সেদিন বিকেলেই একটি এ্যাম্বুলেন্স নিপুদের বাড়ির সামনে থামল। পেছন থেকে দাদা বের হলেন। আড়কোলা করে বোনের লাশটি নিয়ে এগিয়ে গেলেন বাড়ির দিকে। মা-বাবা তখনও কিছু জানেন না। তাদের কি বলবেন তা দাদার জানা নেই। শুধু জানেন, লক্ষ্মী বোনটি তার কথা রেখেছে। বাংলাদেশ জিতেছে; তাইতো বোনটি এখন তার কোলে- ঠিক ছোটবেলার মত। বোন বড় হয়েছে কোথায়? আজ সে এতই ছোট যে হেঁটে একা বাড়িতেও আসতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, আজকের পর বোনটি অনেক বড় হয়ে যাবে- এত বড় হবে যে আর কোনদিনও তাকে দাদা কোলে নিতে পারবেন না- বাংলাদেশ জিতলেও না...
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাহাতাব রশীদ (অতুল) ভোট দেও শেষ দিন।সবাইকে উতসাহিত করছি।১ম থেকে ৫ম এর ভিতরে না থাকতে পারলে দুকখ করার মানে নেই।কারণ একদিন সবারি জিত হবে।
এস, এম, ফজলুল হাসান অনেক ভালো লেখেছেন , ধন্যবাদ আপনাকে
মুশফিকুর রহমান সুমিত আমার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
বিষণ্ন সুমন খুবই বিয়োগান্তক গল্প. তবে কষ্টের অনুভুতির চিত্রটা আর একটু আবেগী করলে পাঠকের মনের গভীরে ছবিটা অনেকদিন জুড়ে থাকত. এটুকু বাদ দিলে অসম্ভব ভালো একটা লিখা. এরকম আরো লিখ এই আশাবাদ রাখি.
আনিসুর রহমান মানিক আপনার লেখা প্রথম গল্পটি পড়তে পেরে ভালো লাগছে /চালিয়ে যান অবস্যই আরও ভালো হবে /
শাহেদুজ্জামান লিংকন আপিন সাইন করতে পারবেন। চালিয়ে যান।

০৩ মার্চ - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪